বিদ্যান সর্বত্র পূজ্যতে

ব্যাতিক্রমী এক বধূবরণ অনুষ্ঠানের সাক্ষী থাকলো শহর জলপাইগুড়ি। যেই অনুষ্ঠানে একদিকে যেমন বাঙালিয়ানাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে পরিবেশ রক্ষার বার্তা দিয়ে বিয়ের কার্ডের সাথে গাছের চারা নিমন্ত্রিতদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।এর সাথে তিলোত্তমার বিচার চেয়ে জনমত গঠনের চেষ্টায় বিয়ের কার্ড থেকে বধূবরণ অনুষ্ঠানের দিন সেল্ফি জোনেও দ্রুত তিলোত্তমার বিচারের দাবী স্থান পেয়েছে। একইসাথে পরিবারের কচিকাঁচাদের মধ্যে দেশপ্রেম ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত করতে পরিবারের গুনীজনদের বধূ বরণ মঞ্চে সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে এক অন্যন্য নজির গড়ে আবার প্রমান করলো পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সেরা শহরের নাম হলো জলপাইগুড়ি।

সমাজ/সামাজিক

12/15/2024

নিজষ্ব সংবাদদাতা, জলপাইগুড়িঃ গত ১৩ ই ডিসেম্বর জলপাইগুড়ি টাউন ক্লাব অডিটোরিয়ামে ছিল শহরের হাকিম পাড়া নিবাসী এক গুনি যুবক দিগন্তর বৌভাতের অনুষ্ঠান। দিগন্ত রায়চৌধুরী জলপাইগুড়ি শহরের ছেলে। বর্তমানে ভাবা পরমানু গবেষণা কেন্দ্রের সায়েন্টিফিক অফিসার। এদিন সন্ধ্যায় তার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় সামাজিক অনুষ্ঠানে একটি ব্যাতিক্রমী সংবর্ধনা অনুষ্ঠান করেন। যেখানে তিনি ও স্ত্রী পৌলমী মিলে তাদের দুই পরিবারের গুনীজন দের সম্মাননা প্রদান করে অনন্য নজির সৃষ্টি করলেন।

অনুষ্ঠানে যারা সম্মানিত হলেনঃ

১) শেখর মজুমদারঃ পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। পূর্ত দপ্তরের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হয়ে অবসর গ্রহন।ইঞ্জিনিয়ার হলেও নেশায় তার ছিল গ্রুপ থিয়েটার। জলপাইগুড়ি চিত্তপট নাট্যসংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। নিজে অভিনয় করা এবং নাটক পরিচালনার পাশাপাশি ছোটদের নিয়ে নাটকের দল তৈরির মাধ্যমে তাদের জীবনে নীতি,আদর্শ সততা ইত্যাদি গ্রথিত করার নিরন্তর প্রয়াস। দিগন্ত শেখর মজুমদারের নাট্য দলে ছেলেবেলা থেকে অভিনয় করত। নাটক করতে গিয়ে শেখার আদর্শ তার জীবনের জীবনে চলার পথে বড় প্রভাব ফেলেছে। তাই এদিনের মঞ্চে শেখর বাবুকে প্রনাম করে সম্মাননা প্রদান করে দিগন্ত রায়চৌধুরী।

২)ক্যাপ্টেন সুব্রত বোসঃ একসময় ভারতীয় বায়ুসেনার গ্রুপ ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব সামলে সফলতার সাথে অংশ নিয়েছিলেন ভারত - পাকিস্তান যুদ্ধে। সেইসময় পাক যুদ্ধে সফলভাবে জাগুয়ার বিমান চালিয়ে শত্রু পক্ষকে গুড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। দিগন্তর পিস্তত দাদা হিসাবে গোটা পরিবারের মধ্যে নিজেকে এই উচ্চতায় পৌঁছে দিয়ে আত্মীয়দের গর্বিত করেছেন। ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি (এনডিএ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এতো বড়ো পদে যোগ দেওয়া এবং পরিবারের ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের স্বপ্ন তৈরি করতেই তাকে এদিন সম্মাননা দিয়ে প্রনাম করা হয়।

৩) শ্রী তপন সাধুখাঁঃ ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক শার্প শুটার (গানার)। চাকরি জীবনে দেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরতে ঘুরতে পুঞ্চ সেক্টরে যোগদান। ১৯৯৬ সালে ২৪ আগস্ট মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে দায়িত্ব পালন করছিলে।সেই সময় পাকিস্তান থেকে আচমকাই শুরু হয় গোলাবর্ষন। পালটা জবাব দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী।গুলির জবাব গুলির মাধ্যমে দিতে গিয়ে ধেঁয়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। এরমাঝে একটা গুলি তপন বাবুর চোখে লেগে মাথা দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর স্প্লিন্টার ছিটে লাগে অপর চোখে চোখে। তৈরি হয় যমে-মানুষে টানাটানি। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করলে তিনি প্রানে বেঁচে গেলেও হারিয়ে ফেলেন দুটি চোখ। এরপর সুস্থ হয়ে দৃষ্টিহীন অবস্থায় ফের সেনাবাহিনীতে সসম্মানে দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করে অবসর। সম্পর্কে দিগন্তের মেশোমসাই। এই অনুষ্ঠানে একজন দেশসেবকের সম্মাননা ও প্রণাম জানানোর সু্যোগ হারাতে চায়নি দিগন্তর পরিবার। তাই তো বধূবরণ অনুষ্ঠানে নববধু পৌলমি দেশসেবকে প্রনাম করে তাকে সম্মাননা প্রদান করে।

৪) দেবাশীষ সেনগুপ্তঃ নববধু পৌলমীর ছোটমামা। উনি পেশায় একজন সফটওয়্যার ডেভেলপার। আর নেশায় গান। সঙ্গীত জগতে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে।ছেলেবেলা থেকেই নববধুকে গানের তালিম দিয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যে দুবার সঙ্গীত আকাদেমি থেকে পুরষ্কৃত হয়েছেন। এহেন গুনি মামাকে তার বধুবরণ অনুষ্ঠানে প্রণাম জানাতে সু্যোগের হাতছাড়া করেনি রায়চৌধুরী পরিবার।

পাত্রের বাবা দেবাশীষ রায়চৌধুরী বলেন,"মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। ছোট থেকে আমি ও আমার বন্ধুবান্ধবরা যেইসব আদর্শ নিয়ে বড় হয়েছি একইসাথে আমাদের ছেলেবেলায় সামাজিক অনুষ্ঠান গুলি যেভাবে দেখে বড় হয়েছি গত দেড় দুই দশকের মধ্যে সেইসব কেমন যেনো দ্রুত বদলে গেলো। বাঙালির অনুষ্ঠান বাড়ি গুলি থেকে ক্রমেই হারিয়ে যেতে থাকলো বাঙালিয়ানা। এছাড়া বর্তমান প্রজন্ম অনেকটাই দিশেহারা। এইসব নিয়ে আমি আমার পরিচিত মহলে খুব আক্ষেপ করি। কিন্তু ওইখানেই শেষ। কিছু আর এগোয় না। এবার যখন নিজের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান এলো তখন আমার মনে পড়ে গেল স্কুল জীবনের শেখা কথা "আপনি আঁচড়ি ধর্ম পরেরে শেখাও"। ঠিক করলাম বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রথম ও শেষ প্রাধান্য পাবে বাঙালিয়ানা। মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে আত্মীয়রা বাড়িতে আলপনা দেবে। অনুষ্ঠানে প্লাস্টিকের ব্যাবহার বাদ দিয়ে পরিবেশ বান্ধব সামগ্রী ব্যাবহার করা হবে।সাথে ঠিক করা হলো আমার পরিবারে যেইসব মানুষ দেশ বা সমাজের জন্য কিছু করেছে তাদের সম্মাননা প্রদান করা হবে। সবকিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর একে একে কাজ শুরু করি। আমার কর্মজীনের বন্ধুরা সহ সকলের সহযোগিতায় অনুষ্ঠান মধুরেন সমাপয়েৎ হয়।"

পাত্র দিগন্ত রায়চৌধুরী জানায়,"আমার চরিত্র গঠনে অনেকটাই অবদান রয়েছে শেখর মজুমদারের। তাই উনাকে আমি জ্যেঠুর মতো সম্মান করি। এছাড়া আমার পরিবারে বেশ কয়েকজন নিকটাত্মীয় রয়েছেন যারা দেশের জন্য সেবা প্রদান করেছেন। ছেলেবেলা থেকে তাঁদের অনেক গল্প শুনেছি। কিন্তু উনাদেরকে নিজের চোখে কখোনও দেখিনি। তাই যখন জানতে পারি রিসেপশনে উনারাও আসছেন তাই এই গুনীজনদের সম্মাননা প্রদান করার কথা মাথায় আসে। এরপর তিলোত্তমা প্রসঙ্গে দিগন্ত বলে তিলোত্তমা নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশ যখন শোকাহত আমিও তাঁদের মতো শোকাহত হই।এরপর শুরু হয় সোসাল মিডিয়া উত্তাল হওয়া।কিন্তু আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তেমন এক্টিভ না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই এই প্রতিবাদ অন্য ভাবে করবো। তাই আমার বিয়ের কার্ড থেকে রিসেপশন পার্টি সবেতেই আমি প্রথম প্রাধান্য দিয়েছি তিলোত্তমার বিচার।"

এহেন সামাজিক অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা পেয়ে আপ্লুত বিশিষ্ট নাট্যকার ও পরিচালক শেখর মজুমদার। তিনি বলেন বিয়েবাড়িতে এইভাবে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আমি আমার জীবনে দেখিনি। ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে আমরা যেই দলটি তৈরী করেছিলাম তারা সবাই এখন সমাজের বুকে ভালো মানুষ হিসেবে যায়গা করে নিয়েছে। এটাই আমাদের প্রাপ্তি। যার উজ্জ্বল উদাহরণ দিগন্ত।

পরিশেষে বলতেই হয় দিগন্ত আজ যা করে দেখালো সত্যিই তা শিক্ষনীয়। সমাজের বুকে এমন দিগন্তরা সদা বিরাজ করলেই এমন মহৎ অনুষ্ঠানের প্রকৃত সার্থকতা আসবে।

আরও পড়ুন